ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শব্দের অলৌকিক ভাস্কর্য: পিয়াস মজিদের কবিতা

বিনয় বর্মন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২৩
শব্দের অলৌকিক ভাস্কর্য: পিয়াস মজিদের কবিতা

“Poetry: the best words in the best order.” - Samuel Taylor Coleridge

ময়ূরের মালঞ্চ,
তবু কুসুম যা ছিল কেকারিক্ত।
দণ্ডিত বিভা নিয়ে
ঠিকঠাক চলে এসো,
দেখা যাবে তোমারই
শবের শোভা।


বিস্তীর্ণ ব্রহ্মের বাগিচায়
কতটুকু কুড়োনো হল
ফুলের ব্যথা!
(পিয়াস মজিদ, ব্রহ্মমিনার)

শব্দই ব্রহ্ম। প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রকারগণ শব্দকে অমোঘ বিবেচনা করতেন। তারা শব্দ দিয়ে রচনা করেছেন মন্ত্র, যে মন্ত্রে সচল হয় ব্রহ্মাস্ত্র। শব্দ বাণীশিল্পের আধার। শব্দকে সঠিক বিন্যাসে সাজিয়ে গড়ে তোলা যায় ভাস্কর্য, যা হয়ে উঠতে পারে পরম সৌন্দর্যের আকর। সৌন্দর্যপিপাসুরা সেই ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে মোহিত হন। কবিতাও হতে পারে ভাস্কর্য। পিয়াস মজিদের কবিতা এমনই এক শিল্পের সন্ধান দেয় যা মেঘপ্রতিমার ন্যায় দৃষ্টিনন্দন। অগ্নিউষ্ণ, হরিণচপল। “কবিতার অধিক নাব্য আগুন। আমি শব্দের হরিণ হাতে পাড়া বেড়াতে যাই” (প্রবচন, কবিতা ইত্যাদি)। শব্দে শব্দে তৈরি সুবর্ণ অবয়ব, যা প্রশিক্ষিত চক্ষুকে কৃষ্ণবিবরের মতো তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। কবিতা এমন এক প্রপঞ্চ “রূপব্রহ্মার প্রচ্ছায়ায় যেখানে শত রক্তলহরির নিঝুম ঝোপ” (স্বর্ণগোধূলি)।

কবিতা হতে পারে সূক্ষ্ম, বাতাসবাহিত। এই সূক্ষ্মতার আবেদনটি চিরকালীন, সর্বজনীন। কবিতাকে সূক্ষ্ম হতে হয় বিদগ্ধ পাঠকের পরিতৃপ্তির জন্য। কবিতা খোলামেলা বা বেশি স্পষ্ট হলে তা শৈল্পিক বিভা হারায়। আবেদনও হারায়। পিয়াস মজিদের কবিতায় আছে গগন-গভীরতা, যা মননমেধায় প্রতিপালিত। মাটির তলায় গুপ্ত খনির মতো। অনেক খোঁড়াখুড়ির পর বেরিয়ে আসে মূল্যবান ধাতু। বক্তব্যে গভীরতা থাকলে তা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বিষয় হয়, গবেষকের চিন্তার খোরাক জোগায়। তবে একথাও স্বীকার করতে হবে, অতি গভীরতা তাৎপর্যসন্ধানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। আবার এটি নিছক প্রতীতিও হতে পারে। সমুদ্রের নীলভতা তার নিজস্ব নয়, আকাশরঙের প্রতিচ্ছায়া মাত্র। আবার আমরা আকাশে যে নীলরঙ দেখছি তাও এক প্রকার আলোর খেলা, এবং তা অবস্থানসাপেক্ষ। সূক্ষ্মতা ও গভীরতার কোন পরিমাপ নয় না। “আসন্ন হেমন্ত আমাদের শীতকামী স্নায়ু। মৃত বিকেলের পাঁজরে সন্ধ্যা গড়ে নিচ্ছিল নিজের নরম তনু” (বিচ্ছেদ ও বুদ্ধদেব)। “বলক ওঠা তারার প্রশ্বাস রাত্তিরে পান করার সঙ্গে সঙ্গে জন্তুদের জিমনেশিয়াম থেকে লংমার্চ শুরু করি পরিদের আবাসিক এলাকা অভিমুখী” (এইসব মকারি)। আমরা কি কবিতার সূক্ষ্মতা ও গভীরতা টের পাচ্ছি?

সূক্ষ্মতার স্বার্থে পিয়াসের কবিতা বয়ান-ব্যাখ্যাকে পরিহার করে। তার কবিতায় কোথাও স্থূলতা নেই, নেই কোন তারল্যদোষ। কোথাও স্লোগানধর্মিতা নেই, নেই নৈতিক উপদেশ দেওয়ার প্রবণতা। ঋজু উচ্চারণে তা হার্দ্য, দার্ঢ্য। তার কবিতা সরলরেখায় হাঁটে না, হাঁটে জটিল পথ ধরে। কবিতা বয়নের কৌশলটি তার নিজস্ব। শব্দকে চটকে তিনি নানা আকার দেন। লাইনগুলো অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব, টানটান। মসলিন তন্তুর টানাপোড়েন। অঙ্গে জড়ালেও তা সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখতে হলে দরকার সূক্ষ্ম দৃষ্টি। পিয়াসের কবিতা বোধ করি সকলের জন্য নয়। তার কবিতার স্বাদ পেতে হলে পাঠককে হতে হবে পরিশ্রমী, বহু পাঠে প্রশিক্ষিত পরিণত রুচির। কাচ কাটার জন্য হীরক লাগে। নখ দিয়ে কাচে আঁচড় কাটা যায় না। যেমন কবি, তার পাঠক হতে হবে তেমন। আমরা পাঠ করি:
এমন ১টা ভাদ্র মাস খোঁপায় বেঁধে
পৃথিবী এখনও কীভাবে এতটা
তোমার ছায়ার সর্বনাম!
(সেরেনিটি)

“এবার একটু ধাঁধা চাই / চাই আঁধারের আভা” (কুরুক্ষেত্রের আলোকুয়াশা)। একবিংশ শতাব্দীর কবির কাজ প্রহেলিকার সাধনা করা। শব্দে শব্দে তৈরি হবে ইন্দ্রজাল। রহস্যে ঘন হয়ে উঠবে বাতাবরণ। পাঠকের মনেও ঘনিয়ে উঠবে সাসপেন্স। আমরা এর নাম দিতে পারি রহস্যরস। “নির্ঘুম নক্ষত্রের নিঃশ্বাসে / জাগরিত তমস আমি / বাঁচতে বাঁচতে মরে উঠি / মরতে মরতে উঠি বেঁচে” (নির্ঘুম নক্ষত্রের নিঃশ্বাস)। পিয়াস শব্দ নিয়ে আশ্চর্য খেলায় মাতেন। তার হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, যা নাড়া দিলেই ঝরে পড়ে অসম্ভব শব্দবন্ধ; অবাস্তব জগত থেকে ভেসে আসে বাক্যবিকার। এ যেন সুকুমার রায়ের সৃষ্টিশীল আবোল তাবোল, ভোলানৃত্য: “আয় যেখানে খ্যাপার গানে / নাইকো মানে নাইকো সুর। / আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায় / মন ভেসে যায় কোন্‌ সুদূর। /…  / আজ্‌গুবি চাল্‌ বেঠিক বেতাল / মাতবি মাতাল রঙ্গেতে- / আয়রে তবে ভুলের ভবে / অসম্ভবের ছন্দেতে। ” সেই অসম্ভবের দুনিয়ায় ভাষার যৌক্তিক রেখাটির অতিক্রমণ ঘটে। তার কবিতায় ব্যবহৃত কিছু কৌতুহলি শব্দযৌগ: তারাশব্দ, স্মৃতিবকুল, জলমিনার, বকুলদহন, তমসাকুসুম, দিগন্তজন্ম, মুক্তাপ্লাবন, শ্রাবণসিঁড়ি, ঋষিসমুদ্র, কুয়াশাছন্দ, দিগন্তপাতাল, হিরণ্যদুপুর, হাওয়াহ্রদ, ময়ূরমুহূর্ত, হননপুষ্প, হেমন্তরুধির, রজনীকুসুম, বসন্তবলি, তমসাকুসুম, নক্ষত্রফল, পারদকুসুম, জল্লাদসৌরভ, প্রজাপতিপ্রোজ্জ্বল, মৃত্যুকুসুমটিলা। কবি-জাদুকর মেঘে মেঘে নির্মাণ করেন প্রাসাদ, বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে রম্যকৃষ্টি। দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে আসে; সৃষ্টি থামে না তার। যেন তার পণ- ‘আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। ’ কবিতার কুয়াশা ছক-আঁটা আরতির দুনিয়া / ধ্বংসের বোধিসত্ত্ব সীমাহারা” (সিলভিয়া, নীল নাচের ভাষা)। এর মধ্যে পাগলামি নিশ্চয় আছে। সৃষ্টির উন্মাদনা যিনি অনুভব করেন, তিনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। পিয়াস নবকল্লোলে ভাসমান মাঝি, বাকশের বাহিরের চিন্তক, নতুন শিল্পের অনুশীলক। “নীল নৈঃশব্দ্যের নন্দন / কোথায় আছে যেন / কৃষ্ণ কোন গহন কল্লোলে” (আত্ম-অপ্রতিকৃতি)। কবিতার ভাঁজে ভাঁজে শব্দদ্যোতনার অনিঃশেষ চমক। চকচকে নতুন মুদ্রার মতো নবদর্শন, নতুন অভিজ্ঞান। প্রথাবাহিত গতানুগতিক ভাষাবিন্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীতে তার অবস্থান। “তোমার ব্যাকরণবিচ্যুত আমি; নিরক্ষর এই অগ্নিপরিধিতে পুড়ে যাচ্ছি কেবল” (রিক্তসুর)। কবিতা নিয়ে কবির নিজের ভাষ্য: “কবিতা এক কালোবর্ণ কুহক। বিষয় ও আঙ্গিক জেনে, ভাষার ওপর দখল নিয়েও এ কুহক চূর্ণ করা যায় বলে মনে হয় না। … কবিতা হলুদ নদীতে চন্দ্রের আলিঙ্গন। … কবিতা উড়ন্ত বিহঙ্গের পতিত কাকলি” (কবিতা মূলত)।

কবিতার উপযোগ আছে কিনা সে তর্কে না গিয়েও আমরা একটি প্রশ্ন করতে পারি, অধরা অমরা শাব্দিক শিল্পবিলাস কি অর্থপূর্ণ, না অর্থহীন? বিশেষ করে যেখানে অর্থের সন্ধান বাতুলতামাত্র। শব্দবাক্য যদি অর্থই প্রকাশ না করে তবে মানুষের সঙ্গে, চিন্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? প্রশ্নটি জটিল, তবে তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ সহজাতভাবে অর্থ অনুসন্ধানী। সুদীর্ঘ বিবর্তনের ধারায় এই বৈশিষ্ট্যের জন্ম হয়েছে। এজন্য মানুষ কোন একটা কিছু পেলেই তার অর্থ খুঁজবে, তা সে বস্তু হোক বা ভাষা হোক, সুশৃঙখল বা বিশৃঙ্খল হোক। যেখানে শৃঙ্খলা থাকে সেখানে মস্তিষ্ককে বেশি কসরত করতে হয় না। কিন্তু বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হলে মস্তিষ্কের কাজ বেড়ে যায়। ভাষা অতিমাত্রায় মেটাফরিক্যাল হলে, অতিমাত্রায় বেঁকেচূরে গেলে এক ধরনের ধোঁয়াশা-কূটাভাস তৈরি হয়। মনে হয় অর্থহীন প্রলাপ। তারপরও মস্তিষ্ক এই অর্থহীনতা থেকেই অর্থ উদ্ধারে ব্যাপৃত হয়। তবে এক্ষেত্রে মস্তিষ্কভেদে ডিকোডিং ভিন্ন হবে। মডার্ন হার্মেনিউটিক্সে একে আমরা বলি মাল্টিপল ইন্টারপ্রিটেশন বা বহুব্যাখ্যা, যা জটাজটিল আধুনিক-উত্তরাধুনিক কবিতাপ্রপঞ্চকে ভ্যালিডিটি প্রদান করে। আপাত বর্ণহীন আলোর মধ্যে যেমন সাতটি রঙ লুকিয়ে থাকে, ব্যাপারটি সেরকম। একেক দর্শকের চোখে আলাদা আলাদা রঙ ধরা পড়ে। পিয়াসের কবিতা একেক পাঠকের কাছে একেক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হবে। পাঠককুল কখনোই তার কবিতার অর্থ নিয়ে একমত হতে পারবেন না। অর্থের বিপর্যয়ে ঘেরা এ এক নতুন নন্দন। পাঠক সন্দিগ্ধচিত্তে বলতে পারেন, রবিঠাকুরের ভাষায়, “কিছু তার দেখি আভা / কিছু পাই অনুমানে / কিছু তার বুঝি না-বা। ” কবি আত্মআস্থায় বলতে পারেন, এ নিছক শব্দের গুবলেট নয়, শিল্প শিল্প খেলা নয়। আরো গভীরে যাও, আরো, আরো… দেখো গভীরতলে জল কলকল। অর্থ নয়, শেষ পর্যন্ত তা ইন্দ্রিয়াতীত অনুভবে গিয়েই শেষ হয়। ‘‘অনুভবের জাল পেতে, দৃশ্যের গায়ে লুকানো শব্দ শিকারের অপরাধকে নাম দেয়া হলো ‘কবিতা’’’ (চক্ষুঘটিত নয়)।

অনর্থবোধক কবিতায় নিশ্চিতভাবে কন্ট্রাডিকশন ও অক্সিমরনের ব্যবহার বেশি থাকবে। থাকবে বিস্তর পদবিচ্যুতি, যার পরিণাম অভূতপূর্ব শব্দমালা, যা তৈরি করে ইন্দ্রিয়বিভ্রাট। অসমঞ্জস বিশেষ্য-বিশেষণ-ক্রিয়াকর্মগুলো এমন অদ্ভুত রূপ ধারণ করে যে নিছক পার্সনিফিকেশন দিয়ে এর ব্যাখ্যা চলে না। শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক অঘনিষ্ঠ, মনে হয় যেন এক সৌরজগতের গ্রহ ভুল করে আরেক সৌরজগতে ঢুকে পড়েছে। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। কবির মনেও এই সন্দেহের উঁকিঝুকি: “তবু ভুল করে যে মধুপথ বেছে নিল সে; লোকে সেই সন্দেহজনক সন্দর্ভকে ‘কবিতা’ বলে ডাকে” (অবশেষ)। ব্যবহারের দিক থেকে এটি ‘শব্দান্তর’, আর সম্পর্কের দিক থেকে এটি ‘দূরান্বয়’। শব্দান্তর/দূরান্বয় এ ধারার কবিতানির্মাণের যুতসই টেকনিক যা অধুনা বিশেষ কবিগোষ্ঠীর নিকট অতি প্রিয়, এবং সেহেতু অতিচর্চিত। এটিই আসলে কবিতার চমকপুলকের উৎস। আমরা পিয়াসের কবিতা থেকে ভুরি ভুরি উদাহরণ হাজির করতে পারি। যেমন বৈপরীত্যমূলক শব্দবন্ধ– স্বাগতবিদায়, ব্যথানন্দ, তমসা-তারা, লাবণ্যপ্রেত, শবজীবন, অমাকরোজ্জ্বল, জলভষ্ম, মরণমধুর, খরাস্নান, সোনালি ভ্রান্তি, স্থিরস্রোতা সমুদ্র, স্পর্শের দূরত্ব। বিষম বহুশব্দপদ–মরীচিকা ফুল, রক্তিম প্রকৌশল, বৃষ্টিকান্তা মেয়ে, অন্ধকারের গর্ভগান, তারাপাহাড়ের সিঁড়ি, ক্রন্দনসিম্ফনির কারুকাঠামো, লাল মোহরের নদী, হিংস্র আলোর দ্যুতি, সমুদ্রের ফেনিল স্থাপত্য, ছিন্নভিন্ন রাতের হেরেম, শত শত জন্মের কাকলি, কণ্টকভূষার গর্বিত ক্রীতদাস, সহস্র রূপমৃত্যুর মঞ্জুষা-ফাঁদ, মরচে পরা আলোর ঝলকানি, কুয়াশাছন্দের অবিরত নাচ, প্রেতপুষ্পলোকের অনন্য আঁতুড়ঘর। ন্যাড়া দৃষ্টিতে এগুলো বেখাপ্পা এবং কিম্ভুত। “জীবনের যাবতীয় মরনঘন স্বাদ” (জীবনের জাদুঘরে)। “নীল শশী / কালো ঊষা / আটকে গেছি সূর্যের অভূত চন্দ্রচক্রবালে” (পারাপার)। “এই উল্লাস অরণিতে কান্নার কারুকাজে নির্মিত কোঠাবাড়ি” (মির্জা গালিব স্ট্রিট)। “রোদের ছায়া থাকে / ছায়াদের রোদ” (নিদারুণ)। “শব্দের ভেতর নৈঃশব্দ্যের সম্মানে ২ মিনিট নীরবতা পালনের পরিসর” (দুপুর)। “তার পিছদুয়ারে গুলবাগিচায় বসে বসে একগুচ্ছ মেঘবালিকা হাঁড়িতে চড়ায় জনমভর কুড়িয়ে পাওয়া রোদেলা মল্লার” (স্বপ্নলিপি)।  শৈশবে ফেলে আসা একটা মরা বিকেল বেয়ে লতিয়ে উঠা নিহিলিজম প্রাক-চল্লিশের রাতে এসে হামা খাচ্ছে” (এইসব মকারি)। “পৃথিবীর প্রতিটি উইপিং উইলোর পাশেই থাকে চিরহাসির স্নানাগার” (প্রাগুক্ত)। শব্দান্তর/দূরান্বয় আমাদেরকে কোন অলৌকিক জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

পিয়াসের কবিতা পছন্দ করে মধ্যম পুরুষের সান্নিধ্য। তার সামনে বসে থাকে অন্য এক ব্যক্তি– কোনো নারী, প্রেমিকা কিংবা কোনো অধিসত্তা। তার সঙ্গে চলে তার নিরন্তর বাতচিত। চলে আনন্দবেদনার কথকতা। মান-অভিমান মিশে থাকে আলোছায়ায় মৌতাতে। অন্তরঙ্গ এই আলাপ, আত্মকথনের সামিল। কল্পনার আল্পনায় সাজিয়েছি তোমাকে যে আমি তোমার আদরের অন্তর্জন্তু” (ফুলগন্ধ অন্ধকার)। “আমার ভেঙে যাওয়ার শীতার্ত শব্দগন্ধে তুমি খুব ঘুরে বেড়াও তোমার বেঁচে থাকার বসন্তবাগানে” (বেঁচে থাকার বসন্তবাগান)। “এই ভিসা-বিশ্বে তোমার অন্তরের অনন্ত অভিবাসী আমি” (স্মৃতিরিক্ত)। “যুক্তাক্ষরময় পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র সোজাসাপ্টা ব্যথা” (কবি)। “তুমি এলে যতটুকু আলো তাতে মেশা গয়নার গন্ধ” (আরও অন্ধকারে)। মধ্যমপুরুষে মধ্যগগন আলোকিত হয়ে থাকে।

এ ধরনের কবিতার একটি বড় দুর্বলতা হলো এর পঠনক্রিয়া দ্রুত ক্লান্তি উৎসারণ করে। যেহেতু পায়ের নিচে মাটি অনুভব করা যায় না, তাই পাঠক বেশিক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। তার মনে হতে পারে তিনি হাওয়ায় ভাসছেন। এ কি হাওয়াই-কাব্য না হাওয়াই-মিঠাই? স্পষ্ট বিষয়প্রেক্ষিতের অভাবে পাঠক অনিশ্চয়তা বোধ করেন এবং আত্মব্যাখ্যায় সন্দিহান হয়ে পড়েন। এক সময় কবিতার সুরটি মনোটোনাস হয়ে দাঁড়ায়, এটি লেখক ও পাঠক উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। মনোটনি সহ্য করা খুব কঠিন। অতিরিক্ত মনোটনি মানসিক অবসাদ তৈরি করে। এজন্য এ ধরনের কবিতার দীর্ঘ চর্চা পরিনামে ডেকে আনতে পারে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। আমি নিজেও দেখেছি এ জাতীয় তুরীয় কবিতা বেশিক্ষণ পড়লে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করে। মস্তিষ্ক শূন্যতার চাপ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না; ভয়েডে মনের ভয়।

তাত্ত্বিক বিচারে পিয়াসের কবিতা সিম্বলিক, সুরিয়েলিস্ট, ইম্প্রেশনিস্ট। যা কিছু বক্তব্য তা ঢাকা থেকে মোটা আবরণে, মেঘের আড়ালে ক্ষীণ সৌরপ্রভার মতো। আমরা চাঁদ দেখি না, দেখি এক ধরনের আবছা চন্দ্রালোক। শ্রুতিদর্শনস্পর্শের পৃথিবী নয়, মনের গহীনে সৃষ্টির কারখানা। তার কবিতায় চাক্ষুষ প্রত্যক্ষতা নেই, বরং সেখানে আছে স্বপ্পধূসরতা। দৃশ্য নয়, দৃশ্যের অন্তরালে ঘটমানতাই তার প্লট-উপকরণ। অন্তর্লোকের দোলাচলে বহির্লোকে কম্পন তৈরি হয়। তাকে প্রভাবিত করে লোরকা, মালার্মে, বোদলেয়ার, র‍্যাঁবো। তাদেরকে উপজীব্য করে কবিতা লেখেন। লোরকাকে স্মরণ করে তিনি লিখেন “ওই নিভে আসে আন্দালুসিয়া”।

ওরা পায়নি আমাকে
ও সীমিত স্বপ্ন
ও স্থির গন্তব্য
আমি তো গুম হই
একমাত্র আমার
নাইটমেয়ারের স্রোতে

“নরকে, র‍্যাঁবোর সঙ্গে” কবি সময় কাটান মাতাল ঋত্বিকের মতো।  
মাতাল কিশোর কবির দেহদাবদারু
তবু এক প্রোজপোয়েম
গীতিগদ্য।
অমিল অক্ষরের আনন্দে
বিড়ম্বিত বেড়ে ওঠা
বাড়িয়ে চলেছি নিজেরই
ডেথ রেফারেন্সের সংখ্যা।

কবিতাকে বিশুদ্ধ শিল্প হয়ে উঠতে হলে তাকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে সমাসীন হলে চলে না। তাকে সমাজ ও সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। কখনো কখনো মানব আচার ও আকার থেকেও। কবিতায় ঘটে বিমানবীকরণ। এভাবে কবিতা নিকষিত হয়, কলাকৈবল্যের রসায়নে। তবে এর ফল যা হয় তা কিন্তু কম মারাত্মক নয়। অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রশ্ন উঠবে সমাজ ও সময়চেতনার অনুপস্থিতি নিয়ে। এর চেয়েও মারাত্মক প্রশ্ন উঠবে শিল্পচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও বাগর্থ নিয়ে। যদি দেশকালের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকে তবে আর কাব্যচর্চা কেন? এঙ্কর না থাকলে নোঙর হয় না। কবিতাকে যদি প্রেক্ষাপটে স্থাপন করা না যায়, যদি তবে আর অর্থোদ্ধারের অপচেষ্টা কেন? কবিকে তার জবাব দিতেই হবে। এর একটাই বড় জবাব হয়, দেশকালের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখলে তা চিরন্তনকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু নিরাধার বিমূর্ত বিদিশাময় কবিতা যে কালজয়ী হবে তার নিশ্চয়তা কী? ‘পিয়াসী’ কবিতাধারা টিকে থাকবে কি থাকবে না, তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে।

স্বাভাবিকভাবে পিয়াসের কবিতায় কোন দ্রোহ নেই। থাকলেও তা এতটাই ম্রিয়মান যে তা অনুভবের রাডারে ধরা পড়ে না। তবে তার কবিতায় যা বহুল পরিমাণে লভ্য তা হলো সূক্ষ্ম হিউমার, যার প্রসাদগুণে কবিতা হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য, বিদ্যুৎঝলকে হ-হা-ময়। “ইরাবতীর অ্যাসাইলামে খানাতল্লাশি চালাও, পেতে পার অমূল্য রতন পিয়ানো কিংবা পিনাট বাটার” (এইসব মকারি)। “ক্যাটস আই কান্না-ধোয়া রাতের দখলে ছিল সিংহের সেই পুরোনো মামা ভোম্বল দাস। ” “ঘাসের পরিসর থেকে অরুণ অশ্রুর অপভ্রংশ গুগল ড্রাইভে তোমাকে দিলাম” (প্রাগুক্ত)। আমাদের কাঁচা-কাঁচা ব্যর্থতার কত দূরে কয়েকটা তাল পাকে?” (ভাদুর মাইসা প্রেম)। “তুলাগদ্যের বালিশে ঘুমায় গানের বেড়াল / মুহুর্মুহু মিউ মিউ থেকে ছেঁকে তোলা নৃত্যের জল” (স্বপ্নস্রোতস্বিনী)। “এই দুনিয়া জাহান বিড়ালের বিউটিপার্লার⎯জ্বলজ্বলে আগুনের সম্ভাবনার সামনে মানুষেরা মিউমিউ সাজপোশাক” (সাজপোশাক)। “হাসপাতালে ঢুকলে মনে হতে থাকে ০১টা চন্দ্রবিন্দু-বিহীন হাঁস এমন মাটিরে পানি ভেবে তই তই করছে” (হাসপাতাল থেকে)। তার ডিকশনটি স্মার্ট, কলোকোয়েল, প্রয়োজনে বিদেশি শব্দঋণে কেতাদুরস্ত।

প্রেম একটা ভূত
প্রেমের পাঁচটা উইন্ডমিল সঙ্গে নিয়ে
ভূতের গলির মুখে দাঁড়িয়ে
সাঁইত্রিশ বছর দেখেছি
প্রেমের হাওয়া খেয়ে
পাহাড় গড়ে ওঠে।
ভূতের বেগার খেটে
সশ্রম প্রেমে জগতের যাবৎ ভূতবৃন্দ
সে পাহাড় কেটে নাছোড় প্রেমেরই পতাকা উড়ায়।

তার কবিতায় অ্যালিউশন এবং কোড-মিক্সিইংয়ের একটি বিশেষ ঝোঁক আছে। দূরবর্তী কোন ঘটনা, ব্যক্তি বা বস্তুকে তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন। কেউ আসে অন্য ভূগোল থেকে, কেউ অন্য সময় থেকে। তারা সুন্দরভাবে জায়গা করে নেয় বাংলা প্রকাশের ভিড়ে। যদিও এটি কবিতাকে তথ্যভারাতুর ও জটিল করে তোলে, তবে এতে ভিন্নতার চমক তৈরি হয়। লুক্কায়িত পাণ্ডিত্যের পরাকাষ্ঠা তো থাকেই। পাঠক যদি অ্যালিউশনের সঙ্গে পরিচিত না হন, তবে তিনি পুরোপুরি কবিতার আস্বাদন করতে পারবেন না। এটি পাঠকের ওপর একটি বাড়তি বোঝা। এমনিতেই কুহক, তার মধ্যে আবার কুজ্ঝটিকা। “জহরতস্রোতে ভেসে এসেছে আফ্রোদিতির কঙ্কাল, লীথির হাড়” (ছয়, নাচপ্রতিমার লাশ)। “সুপর্ণা-জিজ্ঞাসায় একজন ভাস্কর চক্রবর্তী মরে পড়ে থাকে” (নিষ্প্রদীপ)। “কী কেমন বিমান চালায় টমক্রুজ মামা” (মুভি দেখার ফাঁকে)। “কোনোটা বঙ্কিমের / কোনোটায় ছাপ মারা শ্রোয়েডিঙ্গার” (আম-আপেলের গল্প)। কোড-মিক্সিং: “আর যত ফেরারি পুষ্পে ছিল ফেলে আসা ফাল্গুনরাত্রির সবুজ কন্সট্রাকশন” (ঝরা পাতার সিংহাসন)। “বিচ্ছেদের ডিটেইলে সমুদ্র প্রেমপূর্ণ” (ফুলে পাওয়া কাল)। “প্রেম মানে ‘তুমি’ নামের ডাউন-মেমোরি লেন” (পুষ্পবাক)। “যুদ্ধ রক্ত রিরংসার লক্ষ লক্ষ অর্কেস্ট্রায়ন” (রাতলিপি)। “স্লিপিং লেমন থেকে ঝাঁপ দিয়ে নামি” (পথচলতি)। “নিজের কাছে এডিট করা নিজেরেই তুলে ধরি” (আমি, তুমি, আপনি)। “মানুষ তুমি আস্ত একটা বিটার বিউটি” (মানুষ তুমি)। “কালিদাসি মেঘে মিশে আছে বোদলেয়ারের বাচ্চাকাচ্চারা” (ফরাসি অনুষঙ্গে দেশি কবিতা)। “লিরিক্যাল বীর্যবান তোমার মক্কেল / তার তানহা ধরে রাখবে ওটিটির আত্মা” (হয়তো এইরকম)। “ককটেল-মকটেল দুনিয়া হিপহপ স্বাদে ভরা। বাংলার ঋতু মরে ঢুকে গেছে সিরিয়াল ও সিরিজের সিজনে সিজনে” (চোখচুক্তি)। “ছোট্ট জীবন বড় হইয়া যায় ডার্লিংয়ের সঙ্গে উরাধুরা লং ড্রাইভে” (ডায়ানার অভিশপ্ত প্রেমিকেরা)। কোথাও চলে ভাষামিশ্রণ ও দূরনির্দেশের যৌথ হামলা - “বুকোস্কির বাক্যে কোহেনের গানে তুমি থাকলে এহেন হালফিলে প্যারাডাইস বাঁচল যত পাস্ট টেন্সে” (সকাল সকাল)। কবিতার নামেও তিনি ইংরেজিবিলাসী। তিনি কবিতার শিরোনাম দেন: ইটস নট সুইসাইডাল, কমেডি অব মিরর, অন দ্য রোড, জার্নি বাই নাইট, মিউজিক মাস্টার, ডেড পোয়েটস সোসাইটি (নামগুলো “ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি” গ্রন্থভুক্ত)। ভাষামিশ্রণ তার দ্বিভাষিক চিন্তার নজির, যেখানে জীবন উন্মিলীত হয় দ্বৈতবীক্ষণে।

পিয়াসের কবিতায় ছড়িয়ে থাকে নিবিড় প্রেমকাম, যা র‍্যাঁবোর কবিতার মতো সংকেতগূঢ়। পাতার আড়ালে লুকিয়ে পাখি সুমিষ্ট কন্ঠে গান গায়। আমরা গানের সুর আস্বাদন করি, পাখিকে দেখি না। “এ জীবনে সমান সত্য তোমার ঘ্রাণ-গীত; মোজা ও গোলাপ” (এইসব মকারি)। কখনো কখনো তার উচ্চারণ হয়ে ওঠে ইরোটিক। “জিন্দেগি জারি আছে, থাকবে / সহজ শর্তে সেঁধিয়ে যাওয়ার / জেনে গেছি কৈবল্য ও কলা” (প্রাগুক্ত)। আবার কখনো কখনো তা অতিক্রম করে শ্লীলতার সীমা। “উন্মত্ত রাত; রতি-বর্ণমালার নির্ঘুম পাঠ শেষে / তোমার বিরান বেডে / আমার কয়টা পিউবিক হেয়ার পেলে?” (প্রাগুক্ত) কিংবা “ভুলতে ভুলতে মনে পড়ে যায় তোমাকে প্রতিটা মাস্টারবেশনে” (বিউটি এণ্ড দ্য বিস্ট)। কবিতায় কি কোনো শুভবোধ নেই? ক্লেদজ কুসুমের আশায় অন্ধকারে বসে নেতি ও ধ্বংসের আরাধনা করাই কি নবশিল্পের কাজ? “নন্দনের নর্দমা ঘেঁটেঘুঁটে / ই ভাদর মাহ ভাদর / পূর্ণ মন্দির তোর” (প্রাগুক্ত)। "ঘুমের গন্ধে বুঝি এটা শীতঋতু। হিমের হরিণ করে জাগরণ হরণ আর জাগৃতি মানে শুনে যাওয়া ফুলের ফুৎকার– যেখানে আমার টলমল পদভার, নন্দনের নালায় তোমার শান্ত শহর আস্ত একটা ডার্টি জোকস" (গল্প বলি)। “এইমাত্র তার অভিজ্ঞান হলো যে কবিতা মূলত সর্বনাশপন্থিদের আখড়া” (কবিতা মূলত)।

জীবন ও মৃত্যুর এবস্ট্রাকশন প্রত্যক্ষ করি আমরা তার কবিতায়, এর কারণ জীবনমৃত্যু দেশকালের গণ্ডিতে বাঁধা নয়। তবে এ জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সমাহার নেই, আছে না-ঘটা ঘটনার বিবরণ। এখানে মৃত্যু আতঙ্কের নয়, আনন্দের। “মৃত্যু মূলত মিউজিক / তাই প্রতিটি কফিনে কিছু সুর লেগে থাকে” (খরাস্নান)। “নির্জন নরক আমাকেই যাপনের জন্য জীবন ফেলে বরণ করেছে মৃত্যু” (স্বপ্নরেখা)। “এমন জন্ম আর মৃত্যুমাঝে এক ত্রিশঙ্কুজাতক বাসে বসে ভাবে বসন্ত তো সমাগত” (সান্ধ্য)। “প্রক্ষিপ্ত পট ছেড়ে সমস্ত মৃত্যু আজ ঐক্যবান” (রিক্তসুর)। “কথা ও নীরবতার নাচে মাটির মেকাপ! / মানুষ তুমি মৃত্তিকাসুন্দর / আয়ুর আস্তানায় আর কতকাল বন্দি! / মৃত্যুর মেহফিলে অভ্যাগতরা এসে গেছে / জিন্দেগি যদিও এক মওতের মহল্লা / প্রতিটি শ্বাসে তৈরি করে চলেছি / আমাদেরই কবরকাঠামো” (এইসব মকারি)। “মৃত্যুতে মৃত্যু নয় / মৃত্যু এক কবিতাকৌশল” (সিলভিয়া, নীল নাচের ভাষা)। “যে যার মতো রাস্তা খোঁজা / ভালোয় ভালোয় পৌঁছে যাওয়া / নিজ নিজ সাড়ে ০৩ হাত” (জানা কথা কিংবা কবিতা)।

কবির জীবন গাদ্যিক; তার কবিতা গদ্যযত্নেলালিত। “একটি গীতিময় মৃত্যুর মোহে কাটাই গদ্যধূসর জীবন” (গোলাপের অভিঘাত)। পিয়াস তার কবিতায় সচেতনভাবে অন্তমিল বর্জন করেন। মধ্যমিল ব্যবহার করেন কদাচিৎ। “উপবাসী গায়িকা / গানের খেতে খোঁজে / ধানের নূপুর” (গানখেত থেকে)। তবে শব্দে শব্দে অনুপ্রাসের সুসাম্য এড়াতে পারেন না তিনি। “লোভের লাভা জ্বলমান; তার আঁচ গায়ে লাগে- অঙ্গার আর ছাইয়ের ডাঁইয়ে পড়ে থাকে মেয়েটার কম্পিত ক্রন্দন” (অবশেষ)। “রতির রাত্রি, দাঙ্গা-দখল-দোয়েল ও ধ্বংসের দস্তাবেজ” (অস্ত জানুয়ারির কবিতা)। “আত্মার অন্ধকার ইন্তেজার / তনুতীব্র তারার তাবাসসুম” (অগ্নিযাপিত)। মূলত ধ্বনির সুষম বিন্যাসেই তৈরি হয় তার কবিতার ছন্দ, এক প্রকার চলমান গদ্যছন্দ। পিয়াসভুবনে গদ্য ও পদ্যের মধ্যে কোনো তফাৎ নাই। এজন্য আমরা তার গদ্যকবিতাকে পঙক্তিতে ভেঙে দিলে যা পাবো, পঙক্তিবদ্ধ কবিতাকে গদ্য অনুচ্ছেদে সাজালেও ঠিক তাই পাবো। কবিতার সুর-স্বাদ পাল্টাবে না। কেবল মোহবশতই তিনি কোনো একটিকে অবলম্বন হবেন। “গদ্য দিয়ে ঘেরাও করা কবিতা / নাকি কবিতা দিয়ে গদ্য / এমন দ্বিধাথরথর পাতালে এসে ঢোকে / প্রয়াত হেমন্তের গেরুয়া বাতাস” (জীবনানন্দ: আমার অসুখ ও আরোগ্য)। লিরিক নয়, কবিতায় তিনি যে গদ্যধর্মিতাই অন্বেষণ করেন তার প্রমাণ: “লিরিকের আলো সয় না আমার/ থাকুক প্রোজ-পোয়েমের অন্ধকার” (মর্মর কারিগরি)।

কবিতামগ্ন সময়ে পিয়াস মজিদ চন্দ্রাহত মানুষের মতো কবিতা লিখে যান। তার শব্দব্রহ্মাণ্ড স্পন্দমান, গতিশীল। তার কবিতায় প্রবেশ করলে আমরা তার হৃদয়ের উত্তাপ টের পাই। পরম যত্ন ও নিষ্ঠায় তিনি তৈরি করেন একেকটি পঙক্তি। অনিন্দ্য ভাস্কর্য। তা আলো ছড়ায় মনে-মননে। কিন্তু সে আলো খরোজ্জ্বল নয়, বরং তা জোছনার মতো নরম, স্নিগ্ধ। পিয়াসের কাব্যোচ্চার উচ্চকিত নয়, বরং নিম্নস্বরে অন্তসলীলা। গভীর, বিদগ্ধ, সংবেদী। সাবলাইম অ্যাবসার্ডিটি, অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের প্রতিফলন পাওয়া যায় তার কবিতায়। শুদ্ধতম উচ্চারণের অলীক সাধনায় সমাহিত তিনি। তার কবিতা পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে। তবে শঙ্কার কথা হলো এ ধরনের কবিতার সমঝদার খুবই অল্প এবং এর পাঠস্রোত দিনদিন আরো সংকুচিত হচ্ছে, যদিও বর্তমান বাংলাদেশে শব্দব্রহ্মী কবিতা নিয়ে কবিদের মধ্যে উৎসাহের কমতি নেই।

[ড. বিনয় বর্মন, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা]

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২৩
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।